আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রূপাত্মক রচয়িতা। "আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বইটি সর্বপ্রথম ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। বইটিতে লেখকের পারিবারিক রাজনৈতিক সম্পৃক্তার ইতিহাস থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতির সাথে লেখকের সম্পর্কের বিবরণ দিয়েছেন। তবে পরবর্তীতে আরো দুই ধাপে বইটি পরিবর্ধিত করে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । বর্তমান সময়ে "রাজনীতি" শব্দটি শুনলেই কেমন একটা নেতিবাচক মনোভাব চলে আসে। কারণ রাজনীতি তার চরিত্র পাল্টিয়েছে। তখন যেটা ছিল অধিকার আদায়ের রাজনীতি, তা এখন ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। আমরা যখন রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ইতিহাস জানতে চাই তখন আমাদের বুঝতে হবে যে এই ইতিহাস রাজনীতিবিদরাই সবচাইতে কাছে থেকে দেখেন। ফলে তাঁরা যখন ইতিহাস লিখেন স্বভাবতই নিজ স্বার্থে আঘাত লাগুক কিংবা নিজ দলের নিন্দা হয় এমন ঘটনা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে মনসুর সাহেব নিজের কিংবা দলের ভুলগুলোকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন।
লেখকের প্রথম জন সভায় বক্তৃতা মাত্র নয় বছর বয়সে। সেখানে তিনি হিন্দু জমিদারদের মুসলিম প্রজাদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় নেতৃত্ব ছিল লেখকের স্বভাবজাত। তিনি খুব কাছে থেকে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত, লাহোর প্রস্তাব, ব্রিটিশ শাসন, দেশভাগ, পাকিস্তানের অপশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বইটিতে উঠে এসেছে সেসবের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা-পার্টি, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এমনকি স্বাধীনতার পরে একসময় বিএনপিতে থেকেও রাজনীতি করেছেন। রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা আদতে হয়না। সকল ঘটনারই বিকল্প ঘটনা থাকে, একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। মনসুর সাহেবের এভাবে দলবদলকে অনেকে কটু দৃষ্টিতে দেখলেও আমি মনে করি রাজনীতির প্রয়োজনেই তিনি এই কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। মানুষের আইডিওলোজি পরিবর্তন হয়, একসময় যেখানে শেরেবাংলার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, সেখানে মুসলিম লীগে আসার পর তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত বনে যান। ছিলেন একুশ দফার প্রণেতা, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেনও। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রী এবং পরবর্তীতে বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা হিসেবে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার পক্ষে। কিন্তু অপশাসনের মাত্রা যখন বেড়ে গেল তখন আর পাকিস্তানের প্রতি ভরসা না রেখে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সমর্থন দিতে থাকেন। রাজনীতি জীবনে নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে একসময় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও, রাজনীতি তাঁকে অবসর দেয়নি। সকল দলের নেতা-কর্মীরাই তাঁঅর কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন এবং তিনি তাদের হাসিমুখে সাহায্য করতেন।
লেখক যুবক বয়স হতেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের। কিন্তু দেশবন্ধুর মৃত্যুতে হিন্দু প্রতিনিধিদের মাঝ থেকে বড় কোনো নেতা তেমন আগ্রহ দেখান নি তাই আর সেটি সম্ভব হয়নি। হিন্দু জমিদাররা তখনকার সময়ে মুসলিম প্রজাদের বৈষম্য কিংবা অবহেলার চোখে দেখতেন, তাই তিনি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন কৃষক প্রজা পার্টি। তবে লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না বলে তখনকার ঘটনাবলী এড়িয়ে গিয়েছেন। পাকিস্তান বিরোধী আ��্দোলনে আমাদে�� ছাত্ররা যে এত বছর সক্রিয় ছিল তার কোনো কথা এখানে নাই। তাছাড়া আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসনের ব্যাপারটাও রীতিমতো বাদ দেয়া হয়েছে।অবশ্য তিনি তখন জেলে ছিলেন। সম্ভবত বইটি পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত হওয়ায় লেখক পাকিস্তানের শাসকদের নিয়ে কড়া ভাষায় কিছু বলতে চাননি। কিছু কিছু বড় নেতা-কর্মীর রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তা আরেকটু বিশ্লেষিত হলে ভালো হতো।কারণ এসব দ্বন্দ্বের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে বাঙালী জাতির নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আমাদের এত বড় একটি মুক্তিযুদ্ধ হলো, গণহত্যা চালিয়ে বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করলো পাকিস্তানীরা সেটা নিয়ে অন্তত একটি অধ্যায় লেখা দরকার ছিল বলে মনে করি। লেখক সেখানে বলেছেন , মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে সেসব আমাদের জানা। বাধর্ক্যজনিত কারণে নাও লিখতে পারেন ব্যাপারটা। বইটির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো লেখক নিজেকে নিয়ে রাখঢাক কম করেছেন। নিজের রাজনৈতিক ভুল কিংবা সহকর্মী-বিরোধীদের ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, দিয়েছেন নিজস্ব মতামত।
প্রায় সাড়ে ছয়শত পৃষ্ঠার একটি বই। বহু ঘটনা সন্নিবেশিত হয়েছে। আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনের অতীত সম্পর্কে জানতে পেরেছি। মনসুর সাহেবের রসবোধ তাঁর বিদ্রুপাত্মক রচনাতে পেয়েছি, এই বইটিতেও তার স্বাদ কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে। বইটি ভালো নাকি মন্দ, সেটা নির্ণয়ের দায়িত্ব পাঠকের। কোনো ইতিহাসের বইয়ের ঘটনাকেই পুরোপুরি সত্য বলে ধরে নিলে হবেনা। আর পাঁচটা বইও পড়তে হবে, ঘটনাগুলো পারস্পারিক সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করেই সঠিক সিদ্ধান্ত ও মতামত দেয়া যেতে পারে। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আপনাদের যদি বর্তমান বাংলাদেশের গোড়ার রাজনৈতিক ইতিহাস জানতে আগ্রহ থাকে বইটি অবশ্যই পড়বেন। হ্যাপি রিডিং।
বইটি পড়তে বা ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন...


No comments:
Post a Comment