বিলেত! এখনো কিছু কিছু মানুষের কাছে এ এক স্বপ্নের নাম। তবে আমরা এখন আর তেমন বিলেত শব্দটা ব্যবহার করি না। ইংল্যান্ড, ইউ কে এমনকি লন্ডনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তা।
রক্ষণশীল বাঙালি সমাজে বিলেতে যাওয়া বা কালাপানি পার হওয়া ছিল ধর্মনাশের নামান্তর। যারা বিলেতে যেতেন, ফিরে এসে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। বিলেতে পরিবারের কোন সদস্য যাচ্ছেন, সেটা মা বা স্ত্রী এর কাছ থেকে লুকানো হত। শুনে মায়েরা অজ্ঞান হয়ে পড়তেন, ধরেই নিতেন ছেলেটা জলে গেল!
এহেন পরিস্থিতিতেও কীসের নেশায় বা আশায় একের পর এক বাঙালি বিলেতে গেছেন?
সন্দেহ নেই, ইংরেজ শাসন, তাদের ঠাঁটবাট এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার হাতছানি অনেক বড় বড় নিয়ামক ছিল। তবে জ্ঞানান্বেষণ এবং স্রেফ ভ্রমণও কাউকে কাউকে কালাপানি পার হতে উৎসাহ জাগিয়েছিল।
বিলেতে মুসলিম হিসেবে পা রাখেন প্রথম ইহতেশাম উদ্দিন এবং আবু তালিব। তাঁরা ইংল্যান্ডের বিশালত্ব এবং সংস্কৃতি চাক্ষুষ করে যারপরনাই বিস্মিত হন৷ দেশে ফিরে ভ্রমণকাহিনী লিখে দুজনেই উচ্ছসিত প্রশংসা করেন৷ তবে ইংরেজ সমাজের কিছু কিছু নেতিবাচক দিক ও উল্লেখ করেন তাঁরা। তাঁদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল অনেকটাই শখে৷
পরবর্তীতে রামমোহন রায় আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে বলা ভালো পাশ্চাত্য সভ্যতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং রেনেসাঁস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিলেত গমন করেন৷ লেখকের মতে, রামমোহন রায় যদি এরকম পরিবর্তনের জনক হন, তবে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর অনেক বেশি প্রায়োগিক ছিলেন৷ তিনি প্রথমবার গিয়ে বিলেতি সংস্কৃতি এবং তাদের জীবন যাপন, শিক্ষা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন৷ পরবর্তীতে দেশে ফিরে পুনরায় ইউরোপ যাওয়ার সময় সাথে নিজের আত্মীয় সহ চারজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রকে নিয়ে যান।
প্রথম দিকে ডাক্তার, ব্যারিস্টার এবং আইসিএস এই তিন ধরনের মানুষ বিলেত বেশি যেতেন৷ বেশিরভাগই খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতেন৷ দেশে ফিরে তাঁদের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতেন সমাজে এবং সমাজের অন্ধকার সংস্কারসমূহ দূরীকরণের প্রয়াস চালাতেন৷ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, গিরিশচন্দ্র বসু প্রমুখের নাম এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এছাড়াও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে পরবর্তীতে ইংরেজ তাড়ানোর সংকল্পে নিয়োজিত হতেও অনেক বিলেতফেরত এরই অবদান বেশি।
বর্তমানের দিকেও তাকিয়েছেন লেখক। ব্রিটেনে বাঙালিদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস সম্পর্কে আলোচনায় দেখা যায় সিলেটি, ঢাকাইয়া এবং পশ্চিমবঙ্গীয় এই তিন শ্রেণীর বাঙালি মূলত ইংল্যান্ডে বিরাজ করেন। এঁদের মধ্যে আঞ্চলিকতা প্রবল হওয়ায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ক্ষীণ। নারীদের অবস্থাও বাংলাদেশী সমাজে বাংলাদেশের মতোই দুর্বল।
ইংরেজদের অনেক প্রভাব সরাসরি উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে পড়েছে। আবার বাঙালিরাও ব্রিটিশ খাদ্যাভ্যাসে বেশ দেখার মতো প্রভাব ফেলেছেন।
গোলাম মুরশিদের এই গবেষণামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে সেই বিলেতে পা রাখা প্রথম যুগ থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালিদের আচরণ, ভাবনা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, সংস্কৃতির বিনিময় ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা এবং লেখকের সুচিন্তিত মন্তব্য রয়েছে।
বইটা পড়ে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে। বাঙালি কোথায় নেই? এই প্রশ্নের জবাব বোধহয় 'বাঙালি কোথাও নেই' এই উত্তরে দুঃখজনকভাবে পর্যবসিত হয়েছে।
বইটি পড়তে বা ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন...
No comments:
Post a Comment