দারিদ্রের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ত্রৈলোক্যনাথ সাহিত্যচর্চায় এসে পরিচিতি লাভ করেন রঙ্গ ব্যাঙ্গের একজন সার্থক স্রষ্ঠা রূপে। সমকালীন লেখকদের মতো সামাজিক উপন্যাস বা শুধুমাত্র বাস্তববাদী উপন্যাস না লিখে একি সাথে হাস্য রসের মাধ্যমে বিদ্রূপের তীর যেমন ছুঁড়েছেন তেমনি তার লেখায় উপস্থিত করেছেন ভূত প্রেত আর কাল্পনিক দৈত্য দানো। বাস্তব এবং কল্পনার মিশেলে অদ্ভুত এক মায়াজাল সৃষ্টি করে ত্রৈলোক্যনাথ পাঠককে আটকে রাখেন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি। বলা হয়ে থাকে তার এক পা ছিল বাস্তবে আর আরেক পা কল্পলোকে, তার প্রথম উপন্যাস কঙ্কাবতী(১৮৯২) কে নিজেই আখ্যায়িত করেছেন ‘উপকথার উপন্যাস’ বলে।
কঙ্কাবতী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি, “এইরূপ অদ্ভুত রূপকথা ভাল করিয়া লেখা বিশেষ ক্ষমতার কাজ। ...এতদিন পরে বাঙ্গালায় এমন লেখকের অভ্যুদয়...যাঁহার লেখা আমাদের দেশের বালক বালিকাদের এবং তাঁদের পিতামাতার মনোরঞ্জন করিতে পারিবে”।
উপকথার উপন্যাস কঙ্কাবতীতে লেখক কঙ্কাবতীকে নিয়ে আসেন রূপকথার জগত থেকে, কঙ্কাবতীর ভাই একটি আম এনে ঘরে রেখে বলল, যে এই আম খাবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। ছেলেমানুষ কঙ্কাবতী সে কথা না জেনেই একদিন আমটি খেয়ে ফেললো, আর ভাই তখন তাকেই বিয়ে করবে বলে ঘোষণা দিলো। লজ্জায় অন্য কোন উপায় না পেয়ে কঙ্কাবতী নৌকা ভাসাল খিড়কি পুকুরের মাঝখানে আর রূপকথার এই সূত্র ধরেই উপন্যাসের শুরু। শুরুর এই অংশটুকু ছাড়া প্রথম ভাগে রচিত হয়েছে বাস্তব জীবনের গল্প, যে গল্পে কুসুমঘাটী গ্রামের বংশজ ব্রাহ্মন তনু রায়। তিন মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছোট বাচ্চা মেয়ের নাম কঙ্কাবতী। মেয়েদের বিয়ে দেবার ব্যাপারে তনু রায়ের আবার পছন্দ ছিল একটু বয়স্ক জামাতা, ছোকরা জামাই গুলো একশত কি দুইশত টাকা দিয়াই বিবাহ করতে চায় বলে দুই মেয়েকে একটু বয়স্ক জামাই দেখেই হাজার টাকা গুনে বিয়ে দিয়েছেন, জামাইদের আর বয়স কতো? একজনের সত্তর আর আরেকজনের পঁচাত্তর। বাস্তব জীবনযাত্রার বাস্তব কিছু ঘটনা প্রবাহের মাঝেই লেখক তুলে এনেছেন মানুষের ভণ্ডামি, কুটিলতা আর নিষ্ঠুরতার কিছু চিত্র।
দ্বিতীয় ভাগে তিনি আমাদের নিয়ে যান রূপকথার রাজ্যে। কঙ্কাবতী নৌকা ভাসিয়েছে আর একে একে পুকুরপাড়ে এসে কঙ্কাবতীর বোন, ভাই, মা, বাবা ছন্দে ছন্দে কঙ্কাবতীকে ডাকছে আর কঙ্কাবতীর জবাবের সাথে সাথেই নৌকা একটু একটু করে মাঝ পুকুরে সরে যাচ্ছে, এই দিয়ে শুরু দ্বিতীয় ভাগ। দ্বিতীয় ভাগের রূপকথার গল্পে একে একে এসে হাজির হয় কাতলা মাছ, কাঁকড়া মহাশয়, ঝিনুক; আসে ভয়ঙ্কর দর্শন বাঘ, নাকেশ্বরী ভুতিনী, ঘ্যাঘো ভূত, ব্যাঙ সাহেব। মশা প্রজাতির মধ্যে কঙ্কাবতী খুঁজে পায় রক্তাবতীকে, দুইজন প্রানের বান্ধবী পাতিয়ে নাম দেয় ‘পচা জল’... মশার ছোট ভাই হাতি, খর্ব্বুর, খোক্কোশ, তাল পাতার সেপাই সহ আরো অনেকেই এসে উপস্থিত হয় গল্পের প্রয়োজনে। যখনি মনে হবে এতো শুধুই রূপকথা তখনি আবার ত্রৈলোক্যনাথ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন বাস্তবে। রূপকথার ভূত প্রেত, অতি প্রাকৃত জীবজন্তুর কথা বলতে বলতেই তাদের সমাজ দর্শনের চিত্র তুলে ধরে ত্রৈলোক্যনাথ আঘাত হেনেছেন মানুষের সমাজের প্রচলিত নিয়ম কানুন আর বিধি নিষেধের উপর, বিদ্রূপ করেছেন তাদের যারা নিজেদের ইচ্ছা মতো বাণী কপচিয়ে শাস্ত্র বলে তাকে চালানোর চেষ্টা করে।
ত্রৈলোক্যনাথের বর্ণনা ভঙ্গী গল্প বলার মতো। সাধু ভাষায় লিখা হলেও সহজ, সরল, অনাড়ম্বর শব্দের ব্যবহারে মনে হবে সামনে বসিয়ে রেখে তিনি শ্রোতাকে গল্প শোনাচ্ছেন। কঙ্কাবতীর শেষে এসে বৈঠকি রীতিতেই ত্রৈলোক্যনাথ শেষ করে বলে গেছেন, তাহার পর? বার বার “তাহার পর তাহার পর” করিলে চলিবে না। দেখিতে দেখিতে পুস্তকখানা বৃহৎ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার মূল্য দেয় কে তাহার ঠিক নাই, কাজেই তাড়াতাড়ি শেষ করিতে বাধ্য হইলাম।
তাহার পর কি হইলো? তাহার পর আমার গল্পটি ফুরাইলো। নোটে গাছটির কপালে যাহা লিখা ছিল, তাহাই ঘটিল।
No comments:
Post a Comment