সমরেশ মজুমদারের “কালবেলা” এমন একটি উপন্যাস যেখানে প্রেম এবং বিপ্লব একসাথে মিলেমিশে হয়েছে একাকার। “কালবেলা” - যার মানে অশুভ সময়। “কালবেলা” আসলেই একটি অশুভ সময়ের চিত্র উপস্থাপন করেছে। যেই চিত্রে আদর্শের পথে হাঁটতে গিয়ে বিপথগামী হয়েছে তৎকালীন অসংখ্য ভারতীয় তরুণ। তাদের মধ্যে অনিমেষও একজন। মূলত অনিমেষের হাত ধরেই সমগ্র উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার তুলে ধরেছেন তৎকালীন সময়টিকে। আর অনিমেষের সঙ্গী হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন মাধবীলতাকে। অনিমেষ আর মাধবীলতার যে প্রেমের সম্পর্ক তা এই উপন্যাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে টপকিয়ে খুব সহজেই এটিকে একটি প্রেমের উপন্যাসে পরিণত করেছে। সুতরাং, “কালবেলা” যেমন একটি রাজনৈতিক উপন্যাস তেমনি একটি প্রেমের বা ভালোবাসারও উপন্যাস হিসেবেও এটি সম্পূর্ণ সার্থক। অবশ্য সমরেশ মজুমদার এটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে দেখতে নারাজ। তিনি এটিকে একটি ভালোবাসার উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই আগ্রহী।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল অনিমেষ। প্রথমবারের মতো কলকাতায় এসেই অনিমেষ পায়ে গুলি খায় পুলিশের। এরপর ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে কলেজের বাম রাজনীতির সঙ্গে কিন্তু তাতে কেমন যেন খটকা থেকে যায় তার মনে। ফলে অস্ত্র হাতে বিপ্লবের পথে হাঁটতে শুরু করে। বিপ্লবের আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে অনিমেষ বুঝতে পারে যে দাহ্যবস্তুর কোন সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। এই বিপ্লবে জড়িয়ে যাবার আগেই অনিমেষের জীবনে জড়িয়ে পড়ে একজন রমণী। যার নাম মাধবীলতা। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এই মাধবীলতা। যে জীবনের সবকিছু দিয়ে ভালোবেসে গিয়েছে অনিমেষকে। তার জন্য ভালোবাসাটিই মনে হয় আসল বিষয়। বিনিময়ে আশা করেনি কিছুই কিন্তু ছেঁড়ে আসে সব অতীত, সব বন্ধন এবং পেছনের সব সম্পর্ককে শুধুমাত্র এই ভালোবাসার টানে। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে যেমন অবাক হয়েছি অনিমেষের ব্যক্তিত্ব নিয়ে তেমনি অবাক হয়েছি মাধবীলতার ক্ষেত্রেও। মাধবীলতার ক্ষেত্রে আমি হয়তো আরও একধাপ এগিয়ে ছিলাম। কারণ এই চরিত্রটিকে যতই আবিস্কার করেছি ততই আমার কাছে মনে হয়েছে এ মাধবীলতা যেন আমারই কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকা। বারবার প্রেমে পড়েছি আমি এই মাধবীলতার। নিজের সর্বস্ব দিয়ে এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বলে মাধবীলতা শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের মাথা উঁচু রাখে, নিজের ভালোবাসাকে সমুন্নত রাখে। ভালোবাসার মাঝে যেন বিপ্লবের আরেক নাম এই মাধবীলতা।
সমরেশ মজুমদারের লেখা “আট কুঠুরি নয় দরজা” এবং “গর্ভধারিণী” বেশ অনেক আগেই পড়েছিলাম। এ দুটো উপন্যাসই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল উনার ভক্ত হবার জন্য। বিশেষ করে “গর্ভধারিণী” উপন্যাসটি ছিল অসাধারণ একটি সৃষ্টি। একই ধারায় উনার “কালবেলা” উপন্যাসটিকেও আমি সম্পূর্ণ একটি সার্থক উপন্যাসের মর্যাদা দিব। কারণ উনার এই উপন্যাসে যেমন উঠে এসেছে সত্তরের দশকের স্বাধীন ভারতবর্ষের চিত্র, তেমনি উঠে এসেছে সেই সময়টি। একই সাথে তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সাথে উঠে এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যক্রমের চিত্র। একদিকে যেমন প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করা হয়েছে তেমনি আরেক দিকে তুলে ধরা হয়েছে শ্রেণীহীন নতুন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখা একদল তরুণের আন্দোলনের চিত্র। রাজনীতির পথগুলো কতটা তির্যক তা এই উপন্যাসটি পড়লেই বুঝা যায়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি একজন নারীর জন্য তৎকালীন সময়ের প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে এখানে। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজের উঁচু, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মানসিকতার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে এসেছে এই সমগ্র উপন্যাসে। বাদ যায়নি একজন নর এবং নারীর পারস্পারিক বিশ্বাসে ভালোবাসার চিত্রটিও। সমরেশ মজুমদারের অসাধারণ এক সৃষ্টি এই “কালবেলা”।
No comments:
Post a Comment